যাইনাব
আল-গাজালিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো,
“সাইয়্যিদ কুতুবকে কেনো হত্যা করা হয়েছিলো? কী অপরাধ ছিলো তাঁর?”
জবাবে তিনি ছোট্ট একটা কথা বলেন: “মা’আলিম ফিত তারিক পড়ো।”
‘মা’আলিম ফিত তারিক’ হলো সেই বই, যেই বইয়ের কারণে সাইয়্যিদ কুতুবকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে। যে বইয়ের কারণে তাঁর ফাঁসি হয়, যে বইটি নিষিদ্ধ হয়, আজ সেই বইটি পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। নানান ভাষায় বইটির অনুবাদ বের হয়েছে। বইটির ইংরেজি অনুবাদের নাম ‘Milestone’, বাংলা অনুবাদের নাম ‘ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা’। একটা বই লেখার কারণে শাহাদাতবরণ? আমাদের কাছে আশ্চর্যজনক মনে হলেও সাইয়্যিদ কুতুবের কাছে তো এটা ছিলো তাঁর শাহাদাতের পেয়ালা পানের উপলক্ষ্য মাত্র। তিনি তো উন্মুখ ছিলেন এমন শহীদী মরণের।
তিনি বলেছিলেন: “আমাদের শব্দগুলোতো নিষ্প্রাণ, নিষ্ফল আর আবেগহীন; যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা আমাদের কথার জন্য শাহাদাতবরণ করি। তখন শব্দেরা জীবন্ত হয়ে উঠে। তারা প্রাণহীন হৃদয়গুলোতে ঠাই নেয়, আর সেই হৃদয়গুলোকেও জাগিয়ে তোলে।”
Milestone পড়ার পর কোনো বিশ্বাসী হৃদয় কি ঘুমিয়ে থাকতে পারে? হিরোসিমা-নাগাসাকিতে ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাট ম্যান’ বোমা পড়েছিলো। তাতেই জাপান তথা পুরো বিশ্ব কেঁপে উঠেছিলো। সাইয়্যিদ কুতুব তো তাঁর বইয়ের পাতায় পাতায় বোমা-বর্ষণ করেছেন। শাসকগোষ্ঠী কিভাবে সেগুলো সহ্য করবে? পাশ্চাত্য সভ্যতার গুণমুগ্ধ মুসলিম সমাজের কাছে তিনি যে বার্তা নিয়ে আসেন, সেই বার্তা কিভাবে পারে একজন মুসলিমকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে?
‘ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা’ বইয়ে তিনি লিখেন:
“ইসলাম মাত্র দু’ধরণের সমাজ স্বীকার করে। একটি হচ্ছে ইসলামি সমাজ, অপরটি জাহেলী সমাজ। যে সমাজের সার্বিক কর্তৃত্ব ইসলামের হাতে এবং মানুষের আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত, আইন-কানুন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, নৈতিক চরিত্র, পাস্পরিক লেনদেন ইত্যাদি সকল বিষয়ে ইসলামের প্রাধান্য বিদ্যমান, সেই সমাজই ‘ইসলামি সমাজ’। অন্যদিকে, যে সমাজের ব্যবহারিক ক্ষেত্র থেকে ইসলামকে বর্জন করা হয়েছে এবং সেখানে ইসলামি আকীদা-বিশ্বাস গ্রহণ ও বর্জনে ইসলামি মানদণ্ড, ইসলামি আইন-কানুন ও রীতিনীতি, ইসলামি নৈতিকতা ও আদান-প্রদান নীতির শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেনি, সে সমাজ ‘জাহেলী সমাজ’।” [ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা, পৃষ্ঠা ১২৩]
আমরা তো মনে করি, একটা সমাজের মেজোরিটি যদি মুসলিম হয়, একটা দেশ যদি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়, তাহলেই বুঝি সেটা ইসলামি সমাজ, ইসলামি রাষ্ট্র। কিন্তু সাইয়্যিদ কুতুব বলছেন ‘না’। তিনি বলেন:
“যে সমাজ ‘মুসলিম’ নামধারী ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত হওয়া সত্ত্বেও ইসলামি শরীয়তকে আইনগত মর্যাদা দান করেনি, সে সমাজ ‘ইসলামি সমাজ’ নয়। নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাতের ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সেই সমাজ ইসলামি সমাজ হতে পারে না।” [ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা, পৃষ্ঠা ১২৩]
এরকম ‘শব্দ-বোমা’ কিভাবে রাষ্ট্রশক্তি সহ্য করবে? এরকম ‘শব্দ-বোমা’ কিভাবে তাগূতী শক্তি মেনে নিবে? দূর্বল হৃদয়ের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত এগুলো মানতে পারে না!
রাষ্ট্র কিভাবে সাইয়্যিদ কুতুবের বইগুলো বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টা করেছিলো সেটা নিয়ে শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযাম (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সুবিখ্যাত ‘তাফসীরে সূরা তাওবা’য় লিখেন:
“যেদিন তাঁকে হত্যা করা হয়েছিলো, সেদিন মিসরে তাঁর রচিত ‘তাফসীর ফি জিলালিল কুরআন’ –এর ৬৪০০০ কপি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো, ‘যার কাছে সাইয়্যিদ কুতুবের কোনো বই পাওয়া যাবে, তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে।’
অথচ তাঁর শাহাদাতের পর তাঁর সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মানুষজন আগ্রহী হয়ে উঠলো, ‘কে এই সাইয়্যিদ কুতুব? তাঁর বইয়ে কী এমন আছে যার জন্য তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হলো?’ তখন বৈরুতের প্রকাশকরা প্রকাশনা জগতে কোনো খ্রিস্টান লোকসান খেলে তাকে বলতো, আরে, তুমি যদি বাঁচতে চাও তাহলে সাইয়্যিদ কুতুবের ‘তাফসীর ফি জিলালিল কুরআন’ ছাপো। বইটি এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিলো যে, খ্রিস্টান প্রকশকরা পর্যন্ত মার্কেটে টিকে থাকতে বইটি ছাপানোর চিন্তা করেছিলো!
তাঁর জীবদ্দশায় ‘তাফসীর ফি জিলালিল কুরআন’ ছাপানো হয়েছিলো একবার। অথচ যে বছর তিনি শাহাদাতবরণ করেন সে বছরই বইটির সাত সংস্করণ ছাপা হয়। আর এখন অবস্থা তো এই যে, পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্ত পাওয়া যাবে না যেখানে সাইয়্যিদ কুতুবের এই তাফসীরগ্রন্থ গিয়ে পৌঁছেনি। এমন কোনো ভাষা পাওয়া যাবে না, যে ভাষায় তা অনূদিত হয়নি।” [তাফসীরে সূরা তাওবা, শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযাম: ১/২৮৪]
লেখাটি নেওয়া হয়েছে লেখক আরিফুল ইসলামের একটি লেখা থেকে। সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ুন- https://bit.ly/37PHV1L
বইটি অনুবাদ এসেছে আধুনিক প্রকাশন থেকে। নাম ছিলো, ‘ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা’। তবে নুসুস থেকে যে অনুবাদ আসছে তা আরো ভালো হবে ইনশাআল্লাহ্।
সম্পূর্ণ বইটি পড়ুন-
0 Comments