সাম্প্রতিক সময়ে ন ডরাই নামে একটি মুভি রিলিজ হয় যা কিনা প্রথম বাংলা সার্ফিং মুভি। এটা নিয়ে ক্রেজ চরমপর্যায়ে। আর হুজুররা করছে বিরোধীতা। সমানাধিকার ও ধর্মান্ধতার কনফ্লিকশন। ন ডরাইয়ের সাথে কি আসলেই ইসলামের কনফ্লিকশন আছে?
প্রথমত ন ডরাই কেন ডিফরেন্ট? কে তা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে? সাদামাটা ব্যাখ্যা হলো,এটা একটা মেয়ের গল্প যে কিনা সার্ফিং করে এবং তার মাধ্যমে সে সামাজিক ও ধর্মীয় (যদিও তারা ট্যাগ লাগায় ‘ধর্মের নামে’)কিছু শেকল ভাঙতে চায়। সেখানে একটা সার্টেইন কিছু ম্যাসেজ আছে যেগুলো ধর্ম ও সমাজকে কনট্রাডিক্ট করে বলে বলা হচ্ছে।
১. নারী পুরুষ সমান। নারী বলে কোনো
কিছু থেকে দমিয়ে রাখা যাবে
না।
২. পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। ধর্ম ও
সামাজিক মূল্যবোধের নামে
নারীদেরকে যারা দমিয়ে রাখতে চায়।
৩. পশ্চিমা গভর্নমেন্ট খারাপ হলেও সেখানে সাধারণ মানুষগুলো অনেক কিউট। তারা আমাদের প্রতি উদার এবং আমাদের অধিকার রক্ষায় তারা জীবন দিয়ে হলেপ ফাইট করে।
৪. বস্তাপঁচা প্রেমটা এবার আরো কিউট।
কারণ সেখানে এবার সাদা চামড়ার নারী
কালো চামড়ার ছেলের সাথে।
৫. ট্যাগ দেওয়া
হয়েছে ‘নারী স্বাধীনতা’। তাহলে পরাধীনতা
কী?
যা উপরে বলা হলো তাই।
এবার আসুন এ সকল ম্যাসেজগুলো বিশ্লেষণ করি।
প্রথমত, Feminism বা নারীবাদের একটা ন্যারেটিভ আছে। যেখানে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে নারীদের উপর পুরুষতন্ত্রের দমন পীড়ন দেখানো হয়। ড্যানিয়েল হাকিকতজুর এ সংক্রান্ত একটা লেখা আছে আর নারীবাদের সাথে ইসলামের সংঘর্ষও ব্যাখ্যা করা আছে।ক
নারীদের উপর পুরুষের ধর্মীয় দমনপীড়নের ইতিহাস ইসলামের সাথে একেবারেই সংগতিপূর্ণ নয়। এটা এনলাইটেনমেন্টের আগে ইউরোপীয় মহলে ছিলো এবং নারীবাদের মূল ন্যারেটিভটা এনলাইটেনমেন্ট পরবর্তী পশ্চিম থেকে আসে।খ এবং সেই গল্পকেই ইসলামিক সামাজিক পারস্পেক্টিভের সাথে ফিট করাতে চায়।
অথচ হিন্দু সমাজের সতীদাহ ও এটাইপ অন্য কালচার বাদে আর বেগম রোকেয়ার বিকৃত ইতিহাস বাদে আমাদের এখানে মুসলিম কর্তৃক নারীশিক্ষা দমনের তেমন কোনো ইতিহাস নেই।
দ্বিতীয়ত, এ মেয়েটির সার্ফিংয়ের ব্যাপারে ইসলামের স্ট্যান্ডার্ড কী? এ দেশে ইসলামের মূল্যবোধের ব্যাপারে ডিসেনসেটাইয করার অন্যতম একটা ওয়ে হলো নিজেদের মতো মূল্যবোধ ব্যাখ্যা করা আর এর বাইরে তুলনামূলক কঠিন ব্যাখ্যা আসলে "এটা প্রকৃত ইসলাম নয়" বলা। [বিস্তারিতঃ হাউজ নিগার; চিন্তাপরাধ- আসিফ আদনান] এখন যে আপনার ইচ্ছার সাথে যতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ করে ইসলামের ব্যাখ্যা করে শিক্ষিত এনলাইটেনমেন্টের কুকুর সুশীলরা তাকেই প্রকৃত ইসলাম বলে ব্যাখ্যা করে। এগুলো সহীহ হাদীস, সীরাহ, সাহাবাদের জীবনে পাওয়া যায় না। বেসিকেলি এখানে সংঘর্ষের জায়গাটা হলো পর্দাপ্রথা। এখন ইসলামে হিজাব বা পর্দার বিধান আমরা কীভাবে বুঝবো? জিওগ্রাফিকেল ব্যাখ্যা দিয়ে, নিজের মতো, নাকি গত বা এ শতকের কোনো 'আলিমের' ব্যাখ্যা থেকে?
কোরান থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামে একটা সুনির্দিষ্ট স্ট্রাকচার আছে। প্রথমত দেখত্ব হবে রাসূল সা. কীভাবে তা ব্যাখ্যা করেছেন,। আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি তোমাদের প্রতি রাসূল পাঠিয়েছি সত্যের সাক্ষ্যরূপে, যেমন সাক্ষ্যরূপে রাসূল পাঠিয়েছিলাম ফির‘আউনের প্রতি।“ মুজ্জাম্মিলঃ ১৫।
অতঃপর প্রথম তিন প্রজন্ম অর্থাৎ সাহাবা, তাবেয়ী (সাহাবাদের ছাত্ররা), তাবে তাবেয়ীরা (তাবেয়ীদের ছাত্ররা) কীভাবে তা ব্যাখ্যা করেছেন। ইমাম বুখারী (৩৬৫১) ও ইমাম মুসলিম (২৫৩৩) ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “সর্বোত্তম মানুষ হচ্ছে- আমার প্রজন্ম। এরপর তাদের পরে যারা। এরপর তাদের পরে যারা। অতঃপর এমন কওম আসবে যাদের সাক্ষ্য হলফের পিছনে, হলফ সাক্ষ্যের পিছনে ছুটাছুটি করবে।”
তারপর এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সঠিক আকীদার আলিমদের ব্যাখ্যা। ইসলামের হিজাবের বিধান কারো পছন্দ অপছন্দের কারণে পালটে যাবে না। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিষ্কারভাবে একজন নারী নন মাহরাম পুরুষদের সামনে যেতে চেহারা, দুই কবজি ও পায়ের পাতা ছাড়া সব ঢেকে যেতে হবে। সেখানে প্রকাশ্যে সার্ফিং তো অনেক পরের ব্যাপার। এটা কেবল একটা পুরুষতান্ত্রিক রুল না, বরং মেইনস্ট্রিম ইসলামের রুল এটা।গ
তারপরও কি এটা দমন পীড়নমূলক? যাদের কাছে এটা দমনপীন মনে হয়-তাদের কাছে কি মিস ইউনিভার্স কম্পিটিশন দমনপীড়ন মনে হয় যেখানে নারীদেহের তুমুল অমর্যাদা করা হয়? বিবাহপূর্ব সম্পর্ক কি অশ্লীল মনে হয় তাদের কাছে যেটা ক্রমান্বয়ে লিভ টুগেদারদের মতো বিষয়কে নরমালাইজ করে, বিয়েকে অপ্রয়োজনীয় করে দেয় আর অসংখ্য হাস্যকর লজিকেল ফ্যালাসিতে তা ভর্তি থাকে? চিয়ারলিডার বা রিসেপশনিস্ট চেয়ারে নারীদের অত্যাধিক চাহিদাকে কি তাদের খারাপ লাগে? তারা কি 'পারস্পরিক সম্মতি'র মতো পিউর সেক্যুলার নৈতিকতাকে নিজস্ব মোরাল স্ট্যান্ডার্ড বানিয়ে নেয়নি?
অর্থাৎ দিনের পর দিন ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থায় লেখাপড়া করা ছেলেমেয়েরা একটি নির্দিষ্ট নৈতিকতা অনুসরণ করে যা ইসলামের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এবং দিনকে দিন একে নরমালাইজ করা হচ্ছে৷ বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ককে কাছে আসার গল্প বা এক্স গার্লফ্রেন্ড বা এক্স বয়ফ্রেন্ডে, সমকামীতাকে রেইনবোতে (তাও ঈদের নাটক)- এমন অসংখ্য। একটা কাল্পনিক সামাজিক ভূত তৈরি করে তাকে ধ্বংস করে তারা হিরো হয়, ক্রেজ হয় তারুণ্যের চোখে। আর এ প্রবণতা পশ্চিমেও আছে। এক মুসলিম মেয়ে অনেক কষ্টে থাকে, হীনমন্যতায় থাকে। তারপর এনলাইটেনমেন্টের সাদা চামড়ার কুকুর (White knight) তাকে রক্ষা করে।ঘ
ইসলাম নারীদের সবকিছুতেই বাধা দেয়। তারা গান করলে পুরুষতন্ত্র বাঁধা দেয়। অথচ অসংখ্য দ্বীনি বোন জাহিলিয়াহ ছেড়ে এসেছে, ইভন রিডলি স্বেচ্ছায় হিজাবে প্রবেশ করেনঙ, প্রচন্ড নারীবাদি অভিনেত্রী হ্যাপি বা জায়রা ওয়াসিম ঘোষণা দিয়ে দ্বীনে ফিরেছেন যারা মুস্তাহাব নিকাবও ছাড়েন না। তারা বিপরীতটা বললেও এসব কখনোই বলে না। হিউম্যানিজমের বস্তাপচা ব্যক্তিস্বাধীনতা তারাই মানে না। তাদের কথা অনুসারে হিজাব না করার সাথে সাথে হিজাব করার স্বাধীনতাও দেওয়ার কথা ছিলো। নির্দিষ্ট কিছু পুশ করে আরেকটাকে মধ্যযুগীয়, নীপিড়নমূলক ট্যাগ দেওয়ার কথা ছিলো না।
একসময় উস্তাদ সায়্যিদ কুতুবের(মিশর) মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পল্টনে বিরাট মিছিল হয়েছিল। অথচ এখন বাংলার অনেকেই তাকে চেনে না। সেসময় এদেশের মুসলিমরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলিম নির্যাতন নিয়ে অনেক সরব ছিলো। মাওলানা মাওদূদি একবার বলেছিলেন মুসলিমরা ব্রিটিশদের শার্ট প্যান্ট পরা তো দূরের কথা তাদের চেহারা দেখাও তারা পছন্দ করতো না।চ এখন মুসলিম যুবকরা জানেও না কোথায় কোথায় পশ্চিম আমাদেরকে দমন করছে। যদিও তারা স্বীকার করে যে ইউরোপের গভর্নমেন্টগুলো খারাপ, কিন্তু সেখানকার মানুষগুলো কত উদার! কত নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন! সেগুলো আয়ত্ব করার জন্য উঠেপড়ে লাগে তারা। এবং দালাল সরকারগুলোও পুশ করে এসব। যেখানে আপন বড় ভাই মারছে সেখানে সাদা চামড়ার ফিরিঙ্গিরা বানিয়ে দিচ্ছে সেলিব্রেটি!
আমি কখনোই শিক্ষা না দিয়ে কেবল লাঠি দিয়ে পেটানো বড় ভাইকে সমর্থন করি না, মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনলোলুপ কারো সাথে বিয়ে দেওয়া সমর্থন করি না। কিন্তু আমার মূল ফোকাসের জায়গা হলো কী ম্যাসেজ তারা দিচ্ছে। আর একটু ব্রুটাল না দেখালে কি ধর্মীয় নৈতিকতার প্রতি অডিয়েন্সের বিদ্বেষ তৈরি হবে?
রাসূল মুহাম্মাদ আল আরাবী সা.বলেন, ইসলামের শুরু হয়েছে যখন তা ছিল গারীব (আগন্তুক, অচেনা, অপরিচিত) অবস্থায়।। এটা আবার ফিরে যাবে সে গারীব অবস্থায়। আর সুসংবাদ হচ্ছে গুরাবাদের (অচেনা, অপরিচিতদের) জন্য।” [মুসলিম, কিতাবুল ঈমান]
Reference:
[ক] ইসলাম ও নারীবাদ- ড্যানিয়েল হাকিকতজু।
[খ] Introduction to the History of Science- George Sarton. (I, 17)
The New Encyclopedia Brittanica- Vol. 8. P. 107.
[গ] বিস্তারিত: পোষাক,অঙ্গ ও দেহসজ্জা- ড.আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর।
[ঘ] How Hollywood FAILS Muslim women
[ঙ] Ridley, Yivon. (2001). In the hand of Taliban. London: Robson Book Ltd.
[চ] যুগ জিজ্ঞাসার জবাব – মাওলানা মাওদূদি।
0 Comments